মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

(১)

কক্সবাজারে ফুটবল টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। গত ৭ জুন কক্সবাজারের রামুর খুনিয়াপালংয়ে টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। রামু উপজেলার খুনিয়াপালং মৌজার ২০ একর সংরক্ষিত বনভূমির উপর প্রায় ৩০০০০ গাছ কেটে এই টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ফিফার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ৩০ কোটি টাকা পাবে ফুটবল ফেডারেশন। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শুধু বনাঞ্চলই উজাড় হবে না, একইসাথে বিপন্নপ্রায় ৫০ টি বন্যহাতির অভয়ারণ্যও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

(২)

ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা – ফিফা গত বছর নভেম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে স্পোর্টস ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে। স্পোর্টস ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্কের দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশ্ব ক্রীড়া সম্প্রদায়ের জন্য একটি সুস্পষ্ট সফলতা অর্জন করা। দ্বিতীয়টি হলো বিশ্বব্যাপী নাগরিকদের মধ্যে জলবায়ু সচেতনতা করা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় খেলাধুলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এমতাবস্থায়, ফিফা কি অবগত আছেন- তাদের অর্থায়নের প্রকল্পে বনায়ন উজাড় করে জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির ব্যক্তয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

(৩)

বর্তমানে কক্সবাজারের বনায়ন উজাড় হয়ে যাওয়ার রুঢ় বাস্তবতা রয়েছে। দুহাজার সতের সালে আগত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ হাজার একর বনও। এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরনার্থীরা মায়ানমার ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে।

(৪)

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে রুপকথার কোন গল্প নয় বরং কঠিন বাস্তবতা। চলমান সময়ে (এ মাসেই) আমরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে (স্পেন, জার্মানি) তে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দাবানল দেখেছি যা বিশ্বের সব রাষ্ট্রীয় নেতাদের চিন্তিত, বিচলিত করেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।

(৫)

গত বছর (২৯ আগস্ট) কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তখন কক্সবাজারের অবস্থা এ রকম ছিল- ছোট ছোট কটেজ, মাটির ঘর ছিল, সেই কটেজ ভাড়া করে থাকতাম। বাবার (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে উখিয়ায় গেছি। তখন উখিয়ায় ঘনজঙ্গল ছিল। উখিয়ায় ঘনজঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়েছে। সেখানে ডাকবাংলোয় ছিলাম। সেখানে বাঘের ডাক, পাখির ডাক শোনা যেতো। হাতি আসতো। যদিও এখন সেখানে সেসবের চিহ্ন নেই। কিন্তু প্রতিবছর তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেতেন। “ প্রধানমন্ত্রীর এহেন স্মৃতিচারণে আমাদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে কয়েক দশক আগের ঘন অরণ্য ঘেঁষা শ্রান্ত-শান্ত-প্রাকৃতিক কক্সবাজার। একইসাথে বর্তমানে বিভিন্ন বাস্তবতায় এসব বিলীন হয়ে যাওয়ার আক্ষেপও প্রস্ফুটিত হয়েছে তার এই স্মৃতিকাতর বক্তব্যে। একইসাথে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী থেকে বনায়ন নিয়ে তাঁর ভালবাসা, আকাংক্ষা অনুধাবন, অনুমেয় করা যায়।

(৬)

গত ৫ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি প্রশিক্ষণ একাডেমি (সাভারে একটি আছে) নির্মাণ করতে ‘রক্ষিত বনভূমির’ ৭০০ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন যৌক্তিক সমালোচনার প্রেক্ষিতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ৭০০ একর জায়গা বরাদ্দের কার্যক্রম স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। উপরিউক্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, বাফুফে’র টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য বন উজাড় করে এই প্রকল্প বন্ধ করাটা সমীচীন। জলবায়ু স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকারাবদ্ধ ফিফা কি আদৌ জানেন- তাদের অর্থায়নের প্রকল্প বন উজাড় করে করা হবে? সারা বিশ্বে নীচের দিকে থাকা ফুটবল র‍্যাংকিং এর ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন আমরাও চাই, তবে তা বনায়ন বিসর্জন দিয়ে নয়। প্রয়োজনে এই প্রকল্প দেশের অন্য কোথাও স্থাপন করার গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হোক।

 (মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। কক্সবাজারের নাগরিক। mmtanim@gmail.com)